কলমে– মিনতি গোস্বামী
আমার বন্ধু লীনার সাত বছরের প্রেমে হঠাৎ ব্রেকআপ ঘটলো। কেন যে এমন ঘটলো আমরা কোন বন্ধু জানি না। লিনার সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি, ওর প্রেমিক নাকি টাকার লোভে কোন বড় লোকের মেয়েকে বিয়ে করেছে তাই লীনার সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করেছে। আমি আর ডোনা ঠিক করলাম লীনাকে যেমন করে হোক স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতেই হবে। কারণ ব্রেক-আপের পর লীনা ঘরবন্দী হয়ে গেছে, কারোর সঙ্গে কোন কথা বলে না। আমরা দেখা করতে গেলে শুধু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলে। ওকে এভাবে দেখতে আমাদের কোন বন্ধুরই ভালো লাগছে না।ওর মা-বাবাও খুব মনোকষ্টে আছে। ও যে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমরা একদিন ওকে জোর করেই কলকাতায় লিটিল ম্যাগাজিন মেলা দেখার নাম করে বাড়ির থেকে বের করি।আমরা তিন বন্ধু সকালে সুপার ধরি। আমাদের সঙ্গে আমার প্রেমিক আবির্ভাবও ছিলো। আমরা তিনজন একধারে বসি, উল্টোদিকের শীটে বসে আবির্ভাব। সেদিন শনিবার বলে রেলের কামরা বেশ ফাঁকাই ছিলো। আবির্ভাবের পাশে বসে এক দম্পতি। ওদের দেখে নিউ কাপেল মনে হচ্ছে।আমরা বেশ মজা করে কথা বলছিলাম লীনাকে হাসানোর জন্য। কিন্তু লীনা একটাও কথা বলছে না। আবির্ভাব মজা করে ওকে বলছে, ” আরে বাবা, ব্রেক আপই তো হয়েছে। পৃথিবী ছেড়ে চলে তো যায়নি। এত শোক করার কি আছে? আউট অফ সাইড, আউট অফ মাইন্ড বলে একটা কথা তো আছে। দেখবে একটা সময় তোমার কাছে সব পুরনো স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবে। ” আমিও বললাম, ” তোর ওই প্রেমিককে নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি আমাদেরও আর ভালো লাগছে না। তুই এবার নিজের জন্য একটু বাঁচ। নিজেকে ভালোবাসার চেষ্টা কর। তোকে যে অপমান করে, তার জন্য কোথা থেকে এত ভালোবাসা আসে রে তোর? “আমার কথা শুনে লীনার চোখ জলে ভরে যায়।সে বলে, ” তোরা বুঝবি না, ও আমার জীবনে কি ছিলো। ওকে ছাড়া এই সাত বছরে আমি একা কোথাও যাইনি। ও যেদিন চলে গেল,, তারপর একদিন মায়ের সঙ্গে বাজারে বেরিয়ে আমার সব অন্ধকার লাগছিলো। মনে হচ্ছিল চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। পার্কে গিয়ে আমার কোলে মাথা রেখে ও কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের যে ছবি এঁকেছিলো, তা এখনও চোখের সামনে ভাসছে। আমি ওকে কিছুতেই ভুলতে পারবো না।’আবির্ভাব বলে,” মালটা তো এখন বিয়ে করেছে শুনলাম। তাহলে তোমার এত দুঃখ কেন? “আবির্ভাবদা ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।শুনেছি ওর বউ খুব সুন্দরী আর ওকে প্রচুর টাকা-পয়সা দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওর এই লোভী রূপটা কখনো বুঝতে পারিনি। ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসতো। ভালো না বাসলে কি আমি ওর এত কাছাকাছি যেতাম। আমরা তো শুধু মন্ত্র পড়ে বিয়েটাই করিনি। শরীর আর মনের দিক থেকে আমরা তো স্বামী – স্ত্রী ছিলাম।’ উল্টো দিকের বৌটি বড় বড় চোখ করে লীনাকে দেখছিলো আর ওর কথা শুনছিলো। আবির্ভাব হঠাৎ বললো,” আচ্ছা, ওর বাড়ি কি বর্ধমানেই? আমি কিন্তু জানি না। “লীনা বললো, হ্যাঁ, আমাদের শহরেই।’ওকে রাস্তায় কোনদিন দেখেছো? “আমি তো রাস্তাতেই বেরোইনি তারপর থেকে।'” ধরো যদি এই মুহূর্তে ওর নতুন বউকে নিয়ে ট্রেনের কামরায় তোমার সামনে বসে থাকে? “আমি তো ওকে সব সময় সামনে দেখতে পাই।'” ঠিক করে বলো তো, এখন দেখতে পাচ্ছো? “‘ হ্যাঁ আবির্ভাবদা, ওর বউ খুব সুন্দর শাড়ি পরেছে।নীল রং ওর খুব প্রিয় ছিলো। ওর বউ তাই নীল শাড়ি পরে মাথায় চওড়া করে সিঁদুর পরেছে। কপালে একটা বড় লাল টিপ। ওর বউয়ের হাত ধরে আমার সামনে বসে এখন মিটিমিটি হাসছে।’সামনের বউটি মুহূর্তে ওর স্বামীর হাত ছেড়ে দেয়।এবার আবির্ভাব বলে,” আচ্ছা ওর নামটা বলো তো। এই শহরে যখন,, তখন একদিন দেখা করে অবশ্যই জানবো, ওর এই পলায়নের আসল কারণ টা কি।ওর নাম হিন্দোল, হিন্দোল বসু। এই তো ক ‘ মাস আগে বিয়ে করেছে। নীলপুরের ঐদিকে ওর বাড়ি।’মুহূর্তের মধ্যে যেন ডানা ঝড় আছড়ে পড়লো ট্রেনের কামরায়।নতুন বউটি তার স্বামীর কলার ধরে ফটফট করে গালি বেশ কয়েকটা থাপ্পর বসিয়ে দেয়। তারপর লীনার চুলের মুঠি ধরে বলে, ” তুমিই সেই সর্বনাশী,যার কাছে শরীরের সর্বস্ব খুইয়ে এসেছে। তাই বলি, নতুন বউ কাছে থাকা সত্ত্বেও কেন কোন সন্তুষ্টি নেই।আমরা সবাই মিলে যত বলি,’ আপনি এসব কি করছেন, কেন করছেন, বৌটি কিছুতেই লীনার চুলের মুঠি ছাড়তে চায় না। বৌটি কিন্তু নীল শাড়ি পরেই ছিলো।শেষে বৌটি বলে, ” মারবো না। এইতো সেই চিটিংবাজ হিন্দোল বসু। আমি ওকে ডিভোর্স দেবো। পয়সা লোভে আমাকে বিয়ে করা? “চুলের মুঠি ছাড়ার পর লীনা বলে,’ ওনাকে আমি চিনিই না।’ ভাগ্যিস হাওড়া স্টেশন এলো, তাই তড়িঘড়ি সবাই নেমে পড়লাম। যতদূর দৃষ্টি যায় বউটি কিন্তু চোখে গিলে খাচ্ছিলো লীনাকে।
Leave a Reply