কলমে-চৈতালী দাসমজুমদার
একটা হাড় কাঁপানো শীতের সন্ধ্যায় একরাশ মন খারাপের মেঘ সরিয়ে বাড়ি ফিরছিলো পলাশ অফিস থেকে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তাটা যেন জনমানুষ শূন্য পলাশ একাই মনটাকে চাঙ্গা করার জন্য গুন গুন করে গান করতে করতে হেঁটে আসছিলো।হঠাৎ যেন পেছন থেকে একটা পরিচিত গলায় পলাশের নাম ধরে ডাকে। পিছন ফিরে চেয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই গা টা যেন ছমছম করতে লাগলো।নিজের ভুল মনে করে মনটাকে শক্ত করে সামনের দিকে হাঁটতে থাকল পলাশ। কিছুটা হাটার পর একটা চেনা গায়ের গন্ধ নাকে এলো অনুভব করলাম আমার পাশ দিয়ে কেউ যেন হাটছে।চোখ ফিরাতেই দেখি রুমকি এক গাল হাসি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে।সাবলীলভাবেই আমাকে প্রশ্ন করল কেমন আছো পলাশদা? আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে থতমত খেয়ে বললাম হ্যাঁ ভালো আছি। কিন্তু তুমি এত রাতে একা কোথা থেকে ফিরছো? তোমার স্বামী কোথায়? তুমি একা কেন? রুমকি কোন উত্তর দিল না মৃদু হেসে বলল আচ্ছা পলাশদা তোমার কি আমার কথা আর একদম মনে পড়ে না? যেন পলাশদা এখন আমার মনে হয় তোমাকে অবহেলা করাটা আমার ঠিক হয়নি। বাবা মার বাধ্য মেয়ে সেজে একটা অচেনা অজানা মানুষকে বিয়ে না করলেই মনে হয় ভালো হতো।আমি তাড়াতাড়ি ওকে বলে উঠলাম না না তুমি ঠিকই করেছো। কারণ আমাদের সকলের জানা উচিত সবটাই ভগবানের হাতে।ভগবানের ইচ্ছাতেই গাছের পাতা নড়ে। দিনের শেষে রাত হয়। তাই তুমি যা করেছো ভালো করেছো। বিশ্বাস করো আমি একা থাকলেও ভালোই আছি।এত রাতে তুমি একা বেরিয়েছো চলো আমি তোমাকে তোমার বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসি।রুমকি তাড়াতাড়ি ঘাড় নেড়ে বলল না না না পলাশদা তোমায় আজ আর দিয়ে আসতে হবে না। আজ আর আমাকে পৌঁছে দিয়ে তোমার কোন লাভ নেই। আমি একাই যেতে পারবো।কেন জানিনা আজ সকাল থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল জানো পলাশ দা। এই রাতে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালোই হলো।আর,যদি কোনদিন দেখা না হয় তাই তোমাকে কিছু জীবনের কিছু সত্য কথা বলতে চাই।তুমি হয়তো ভাবছো তোমার সাথে প্রতারণা করে আমি অন্য জনকে বিয়ে করেছি শুধু নিজের সুখের জন্য……….না পলাশদা না, সেটা একেবারেই সত্য না……।ওরা মানে আমার বাবার পোশা ডনেরা তোমাকে মেরে ফেলবে বলছিল হ্যাঁ বারবার বলছিল আমি যদিও তোমাকে বিয়ে করি তাহলে ওরা তোমাকে শেষ করে দেবে।আমার ভয়ে হাত পা কাঁপছিল আমি তোমাকে হারাতে চাইনি পলাশদা।আমাকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে অত্যাচার করতে থাকে শুধু তোমাকে বিয়ে করব বলার জন্য।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি পলাশদা। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ও মাপ করতে পারব না….…. আমি শুধু তোমার জন্য ওই বদমাইশ লোকটাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়ে ছিলাম।তুমি আমায় বোঝার চেষ্টা করো পলাশদা। আমি জানি আমি ছাড়া তোমার বাঁচা খুব কঠিন আর তুমি এটাও জেনে রাখো। তুমি ছাড়া আমার বাঁচাও কঠিন।পলাশ বলে উঠলো থামো না কেন এসব কথা বলছ যেটা হয়ে গেছে সে নিয়ে আর না ভাবাই ভালো। অনেক রাত হয়েছে তুমি তোমার বাসায় যাও।
রুমকি পলাশের পায়ের কাছে জোড়হাত করে বসে পড়ল পড়ে বলতে লাগলো তুমি আমায় এখনো ক্ষমা করোনি পলাশদা। তুমি যদি ক্ষমা না করো আমি নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারবোনা।ওঠো রুমকি তুমি জানো না তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি আবার অফিস জয়েন করেছি। তুমি যদি এমন কর আমি কি করে বাঁচবো বলো তো।তোমায় অনুরোধ করছি তুমি বাড়ি যাও।প্লিজ রুমকি বোঝার চেষ্টা কর। এতো রাতে রাস্তায় আমাদের দুজনকে দেখলে আবার অশান্তি সৃষ্টি হবে। তুমি বাড়ি যাও।রুমকি হঠাৎ করে পলাশ কে জড়িয়ে ধরে বলে পলাশদা আমি তোমার থেকে কিছু চাই না আজকের রাতটা আমি তোমাকে চাই।রুমকি পলাশকে জড়িয়ে ধরতেই হঠাৎই যেন পলাশের শরীরের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি উপলব্ধি করতে লাগলো।রুমকির কথা রাখার জন্য ওরা সেই পুরো বাড়িতে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। অন্ধকার খুঁটঘুটে রাত পলাশের হাত ধরে রুমকি বাড়ির ভেতরে ঢুকলো এবং সেই পরিচিত জায়গায় দুজনে গিয়ে বসলো। রুমকির হাতটা পলাশের হাতেই ছিল।পলাশের মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা যেদিন প্রথম রুমকি বন্ধুদের সঙ্গে কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। বড়লোকের মেয়ে প্রাণোচ্ছল রূপ যেন ফেটে পড়ছিল রুমকির।প্রথম দেখাতেই পলাশ রুমকির প্রেমে পড়ে যায়। প্রত্যেকটা দিন ছুটির সময় পলাশ রুমকির কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো।রুমকি আড় চোখে দেখে চলে যেত নিজের বন্ধুদের সাথে।এইভাবে প্রায় তিনটি মাস কেটে গেছে হঠাৎ সেদিন রুমকি একাই আসছিল কলেজ থেকে ওর সাথের বন্ধুরা কেউ ছিল না।পলাশ ওই দিন খুব সাহস করে রুমকির হাতে একটা চিঠি গুজে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিল।রুমকি চিঠিটা নেবে কি নেবেনা পড়বে কি পড়বে না ভাবতে ভাবতে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়েছিল।বাড়িতে পৌঁছে বার বার রুমকি চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সব সময় ওর কাছে আছে ওর বাবা-মা ছিল।সেদিন রুমকি রাতের ডিনার সেরে দরজা বন্ধ করে খুব সাবধানে চিঠিটা খুলে ছিল ও ।জানতো বাবা-মা যদি কোন প্রকারে জানতে পারে তাহলে ওকে আর আস্ত রাখবে না ।চিঠিটাতে লিখেছিল ………প্রথম দেখায় তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে?এইটুকুই ছিল চিঠিতে।রুমকিও হয়তো তার মনের কোন এক স্থানে পলাশকে জায়গা দিয়েছিল তাই সারারাত ধরে পলাশের চিঠিটা বারবার ধরে চোখ বোলাচ্ছিল।সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো রকমে নাস্তা সেরে রেডি হয়ে কলেজের পথে বেরিয়ে পড়ল।ওর বারবার মনে হচ্ছিল পলাশকে কখন একবার দেখবে। বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে এমন সময় রাস্তার এক সাইডে বাইক নিয়ে পলাশ দাঁড়িয়ে। রুমকি সারা শরীরে চুম্বকের মতন শিহরণ জেগে উঠলো খুশির আবেগে। পলাশ ইশারায় রুমকিকে গাড়িতে বসতে বলল। রুমকিও চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। পলাশ বাইক স্টার্ট নিয়ে সোজা তিস্তা নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছাল। নির্জন জায়গা কেউ কোথাও নেই দুজনে বালিয়াড়ির ওপর বসলো। আর ভালোবাসার কথা , রুমকির রুপের কথা বার বার বলতে লাগলো। রুমকি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল।এইভাবে দেখতে দেখতে কখন বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। সন্ধ্যা তখন গড়িয়ে এসেছে পলাশ রুমকির বাড়ির একটু আগে ছেড়ে দেয়। রুমকি বাড়ি চলে যায়। এইভাবে বিভিন্ন জায়গায় ওরা প্রতিদিন দেখা করতো, সময় কাটাতো।পলাশ রুমকি কে প্রশ্ন করে তোমার মনে পড়ে আমাদের প্রেমের প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডে। রুমকি হুম ,বলে পলাশের আরো ঘনিষ্ট হয়েছিল সেই মুহূর্তে।ভালোবেসে তোমার হাতে একটা গোলাপ ও একটা লিপস্টিক দিয়েছিলাম, তুমি ওই অল্প জিনিসেই কত খুশি হয়েছিলে.…………মনে পড়ে রুমকি?আর এই পুরনো বাড়িটায় আমরা দুজন প্রায়ই এসে বসে থাকতাম। তুমি বলতে এই বাড়িটা আমার খুব প্রিয়। মনে পড়ে?রুমকি বলে ওঠে, হ্যাঁ পলাশ দা, আমার সবকিছু মনে পড়ে তাই তো আজ তোমার হাত ধরে এই রাতটা এখানেই কাটাতে চেয়েছি।আর জানো পলাশদা তোমার জীবন বাঁচাতে চেয়ে বাবার কথা মত তাদের পছন্দের পাত্রকেই বিয়ে করলাম। তারপর কি হল তুমি জানতে চাইবে না?পলাশ বলল না রুমকি আমায় তোমার কষ্টের কথা বলার দরকার নেই ।আমি সবসময় চেয়েছি তুমি সুখে থাকো আনন্দে থাকো তোমার সুখেই আমার সুখ।কিন্তু আজ তোমাকে দেখে আমার বড়ই কষ্ট হচ্ছে বারবার মনে হচ্ছে তুমি সুখে নেই যদি সুখে থাকো তাহলে কেন আজ এই মধ্যরাত্রে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করবে।রুমকি বলে উঠলো ছেড়ে দাও পলাশদা আজ যতটুকু রাত বাকি আছে, এসো না। আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে একে অপরের কাছে থাকি ।যেন পলাশদা আজ আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে আমি তোমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে গান করব আর তুমি আমার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে। এই বলে রুমকি পলাশের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে গান গাইতে শুরু করলো পলাশ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না।কাক ভোরে সূর্যের মৃদু আলো আর একটা মুরগির ডাকে পলাশ ধর পড়িয়ে উঠে পড়ে মনে মনে ভাবে লোকে দেখলে বলবে কি। চোখ খুলেই রুমকিকে ডাক দেয় রুমকি কিন্তু কি আশ্চর্য আশেপাশে কোথাও রুমকি কে দেখতে পায় না ।পোড়ো বাড়িটা যেন পলাশকে গ্রাস করতে আসছে। রুমকি কে খুঁজে না পেয়ে তাড়াতাড়ি মেন রাস্তার দিকে চলে আসে।সবটাই যেন পলাশের চোখে সাজানো স্বপ্ন।মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন এসে ভিড় করে কিছুতেই কিছু সমাধান খুঁজে পায় না। দুশ্চিন্তায় পলাশের মাথায় পাহাড় জমে যায়। আস্তে আস্তে মেন রাস্তায় এসে পড়ে।মেন রাস্তার খুব কাছেই রুমকিদের বিশাল বড় রাজপ্রাসাদের মতন বাড়ি।বাড়ির সামনে কিছু লোক জটলা বেঁধে রয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার শব্দ।পলাশের গা-হাত-পা কাঁপছে তা সত্ত্বেও মনের জোর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে?উত্তর দিলেন মিত্তির বাড়ির একমাত্র মেয়ে রুমকি কাকে ভালোবেসেছিল।তার সাথে তার বাবা-মা বিয়ে দেয়নি…… মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে কাল রাতে।পলাশ বলে উঠলো সে কি ?সে কি করে হয়………কিছু প্রশ্ন করার আগেই পলাশ আস্তে আস্তে নিজেকে কোন রকমের সামলে বাড়ি চলে আসে। আর পারছে না পলাশ, মাথাটা ভন বন বন করে ঘুরতে ঘুরতে খাটের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে যায় কিন্তু কাউকেই ওই রাতের কথা বলতে পারেনা।
Leave a Reply